kawsar

Sunday, October 07, 2012

মোবাইল পুশ সেল গ্রাহকরা অতিষ্ঠ

মোহাম্মদ কাওছার উদ্দীন
অযাচিতভাবে গ্রাহককে ওয়েলকাম টিউন, গান বা অন্যান্য ভ্যালু অ্যাডেড সার্ভিস গছিয়ে দেয়া হচ্ছে। কখনও কখনও একটি অফার ফ্রি দিয়ে দুই সপ্তাহ পর কিছু না জানিয়ে সেবাটি গ্রাহকদের জন্য চালু করে দেয়ার ঘটনা খুবই নিয়মিত। সবচেয়ে মুশকিলের কথা হলো, একবার একটি সেবা গছাতে পারলে সেখান থেকে আর বেরিয়ে আসার সুযোগই পাচ্ছেন না গ্রাহক। নিয়ন্ত্রণ কমিশন বিটিআরসি এটিকে বলছে মোবাইলের পুশ সেল। এ পুশ সেলের মাধ্যমে মাসে গ্রাহকদের অন্তত দেড় থেকে দুইশ' কোটি টাকার ক্ষতি হয় বলে দাবি বিটিআরসির।
আবার পুশ সেল বিষয়ে নানা নির্দেশনা দেয়া হলেও সেগুলো অনেক অপারেটর আমলে নেয়নি বলে জানা গেছে। তারা বলছে, গ্রাহকদের সঙ্গে এমন প্রতারণা সহ্য করা হবে না। সেক্ষেত্রে প্রথম দফায় অপারেটর ধরে ধরে কারণ দর্শানোর নোটিস দেয়া হচ্ছে। এরপর জরিমানাও করা হবে বলে জানিয়েছেন বিটিআরসির এক শীর্ষ কর্মকর্তা। একই সঙ্গে এ বিষয়ে গ্রাহকদের সচেতন করতে নানা প্রচারসহ ফেসবুকে অভিযোগ নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। ভুক্তভোগী একজন গ্রাহক জানান, একবার না বুঝে রাশিফল জানার চেষ্টা করে তিনি এমন বিপদে পড়েছেন যে, সেখান থেকে আর বেরোতেই পারেননি।
আড়াই বছর ধরে প্রতিদিন সকালে তার আড়াই টাকা করে কাটা যাচ্ছে। দফায় দফায় অভিযোগ করেও সমস্যার কোনো সুরাহা হচ্ছে না বলে জানান তিনি।
ইন্দিরা রোডের নিশি হঠাৎ করেই তার মোবাইল ফোনে চার ডিজিটের একটি নম্বর থেকে ফোন পান। ও প্রান্ত থেকে নিশিকে গান ডাউনলোড করার অনুরোধ জানানো হয়। পরপর তিনদিন ফোন করার পর একপর্যায়ে বিরক্ত হয়ে নিশি তাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহারও করেন; কিন্তু তাতেও দমে যান না তারা। সময়ে-অসময়ে ফোন আসতেই থাকে। মাঝে মাঝে এসএমএসও আসে। এ বিষয়ে বিটিআরসি বলছে, বিশ্বের কোথাও এভাবে গ্রাহককে বিরক্ত করে কোন পণ্য বিক্রি করার রেওয়াজ নেই।
একজন গ্রাহক একটি মোবাইল সেট জিততে এক মাসে ১০ হাজার টাকার এসএমএস করেছেন। পুরস্কার পাওয়া হয়নি তার। এমনকি তিনি জানতেও পারেননি প্রতিযোগিতায় তার অবস্থান কততম। প্রথম যে ১০ জন পুরস্কার জিতেছেন তারাই বা কত এসএমএস করে জিতলেন মোবাইল সেটগুলো, সেটিও জানতে পারেননি তিনি।
বিটিআরসি বলছে, পুশ সেলের মাধ্যমে অপারেটরগুলো গ্রাহককে বিভিন্ন ভ্যালু অ্যাডেড সার্ভিস কিনতে বাধ্য করে। নানা প্রলোভন দেখিয়ে তারা গ্রাহককে এটি কিনতে বাধ্য করে বলেও অভিযোগ রয়েছে। এ জন্য অনেক ক্ষেত্রে সময়ে-অসময়ে ফোন করে বা এসএমএস পাঠিয়েও গ্রাহককে বিরক্ত করে। এ বিষয়ে তাদের কাছে অনেক অভিযোগও এসেছে।
এসব বিষয়ে বিটিআরসির ভাইস চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন আহমেদ বলেন, কমিশন অপারেটর ও গ্রাহক উভয়ের নিরাপত্তার ছাতা হিসেবে কাজ করে। কয়েকটি অপারেটর তো বেশি কথা বলার বিনিময়ে মোবাইল হ্যান্ডসেট উপহার দেয়ার বিজ্ঞাপন দিচ্ছে। এভাবে মাত্র কয়েকটি হ্যান্ডসেট উপহার হিসেবে দিয়ে হাজার হাজার লোককে অত্যধিক কথা বলতে উৎসাহী করছে বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, অপারেটররা এখন সবচেয়ে বেশি গ্রাহক ঠকাচ্ছে ব্যান্ডউইথ বিক্রির মাধ্যমে। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী আশফিয়া করিম জানান, ৩২০ টাকা দিয়ে এক গিগাবাইট ব্যান্ডউইথ কেনার পর সামান্য কিছু কাজ করেছেন তিনি। পরে দেখেন আর কোন টাকাই অবশিষ্ট নেই। তবে মোবাইল ফোন অপারেটররা জানিয়েছেন, এক মাসের বান্ডেল কোন গ্রাহক নিলে এরপর তার আর কোন ব্যান্ডউইথ থাকারও কথা নয়। তবে বিটিআরসি বলছে, মোবাইল ফোনের অব্যবহৃত টাকা যদি থেকে যেতে পারে তাহলে অবশ্যই ব্যান্ডউইথের টাকাও থাকতে হবে। এটি কেটে নেয়া যাবে না।
একইভাবে কৌতুক শোনা, মোবাইলে নতুন গান শোনা ও সুন্দর ওয়ালপেপার দেখানোর জন্য হরহামেশাই মোটা টাকা কেটে নিচ্ছে অপারেটররা। এক গ্রাহক অভিযোগ করেছেন, একটি অপারেটর কারিনা-সাইফের হট ভিডিও দেখানোর এসএমএস পাঠাচ্ছে। গ্রাহক বুঝে না বুঝে ইয়েসে ক্লিক করলেই তার অ্যাকাউন্ট থেকে ৩০ টাকা কেটে নেয়া হচ্ছে। এভাবে গ্রাহক ঠকানো বন্ধ করতে বিটিআরসি ব্যবস্থা নিচ্ছে বলে জানা গেছে।
সর্বশেষ গত ২৬ সেপ্টেম্বর বিটিআরসি জানিয়েছে এই পুশ সেলের ব্যাপারে নীতিমালা করতে যাচ্ছে তারা। এ সংক্রান্ত খসড়া নীতিমালার একটি কপি গণশুনানির জন্য বিটিআরসির ওয়েব সাইটে দেয়া হয়েছে। সেখানে দুটি ই-মেইল ঠিকানা (ৎযধংংধহ@নঃৎপ.মড়া.নফ ও ংঁহলরন@নঃৎপ.মড়া.নফ) দেয়া হয়েছে। যাতে গ্রাহক চাইলে তাদের মতামতও দিতে পারেন। বিটিআরসি জানিয়েছে, গ্রাহকদের মতামত নেয়ার পর এক থেকে দেড় মাসের মধ্যে তারা এ সংক্রান্ত নীতিমালা চূড়ান্ত করবে।
বিটিআরসি বলছে, গ্রাহক অপট-ইন বা রেজিস্ট্রেশন করলেই তাকে সেবাটি দেয়া যাবে। একই সঙ্গে এ বিষয়ে প্রচারিত বিজ্ঞাপনে সেবাটি গ্রহণ করার পদ্ধতির পাশাপাশি ডি-রেজিস্ট্রেশন পদ্ধতি বা এখান থেকে বেরিয়ে আসার পদ্ধতিও সমান গুরুত্ব দিয়ে উল্লেখ করতে হবে। তাছাড়া গ্রাহক যদি ভয়েস এবং এসএমএস-এর বাইরে আর কোন সেবা না চায় তাহলে 'ঝঞঙচ অখখ্থ লিখে সব সার্ভিস থেকে যাতে বেরিয়ে আসতে পারে সেই ব্যবস্থা কার্যকর করতে হবে।
বিটিআরসির প্রাথমিক প্রস্তাবে রয়েছে, কোন সেবা দেয়ার ৭২ ঘণ্টা আগে একবার এবং ২৪ ঘণ্টা আগে আরও একবার নোটিফিকেশন দিতে হবে। প্রিপেইড গ্রাহকদের আউট গোয়িং কলের ক্ষেত্রে প্রতিবার কল শেষ হওয়ার পর কলটির জন্য খরচ হওয়া টাকা-মিনিট এবং গ্রাহকের বর্তমান ব্যালান্স জানাতে হবে। তাছাড়া বর্তমানে একাধিক অপারেটর প্রতি ঘণ্টা/মিনিট/মাসে সর্বোচ্চ কথা বলার জন্যে পুরস্কার দিলেও ভবিষ্যতে এটি করা যাবে না বলে খসড়া নীতিমালায় বলা হয়েছে। শট কোড বা হেল্পলাইন নম্বর থেকে ফোন করার ক্ষেত্রে গ্রাহককে বিভ্রান্ত করা বা তার সময় ক্ষেপণ করা যাবে না।
বন্ধ সিম চালু করার ক্ষেত্রে অপারেটররা এখন অনেক সুবিধা দিতে চাইছে। এক্ষেত্রে মূল গ্রাহক ছাড়া অন্য কাউকে সিম রিপ্লেসমেন্ট দেয়া যাবে না। বন্ধ সংযোগে বোনাস বা অফার যাতে মূল গ্রাহকই পেতে পারে সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট পদ্ধতির মাধ্যমে অপারেটরকে নিশ্চিত করতে হবে। তাছাড়া একটি সিম মাত্র একবারই বিক্রি করা যাবে। তাছাড়া বন্ধ সংযোগ ফিরে পতে চাইলে গ্রাহকের কাছ থেকে নতুন করে সিমের দাম নেয়া যাবে না।
কোন গ্রাহক কল করলে তার রিং ব্যাংক টোন শুরু হওয়ার পূর্বে মোবাইল অপারেটরের নিজস্ব বিজ্ঞাপন প্রচারিত হতে থাকে। একই সঙ্গে গ্রাহকের মিসড কল অ্যালার্ট চালু থাকলেও সেখানেও বিজ্ঞাপন শুনতে হয়। গ্রাহক কাস্টমার কেয়ারে ফোন করলে সেখানেও বিভিন্ন প্রমোশনাল বিজ্ঞাপন শুনতে হয়। বিটিআরসি বলছে, এগুলো প্রতারণার শামিল। খসড়া নীতিমালায় তারা বলছেন, এ ধরনের প্রতারণা করা যাবে না।
বিটিআরসি বলছে, ইন্টারনেটের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয় গ্রাহকদের। তারা বলছে, ২০০৪ সালে প্রতি মেগাবাইট ব্যান্ডউইথের মূল্য ছিল ৭২ হাজার টাকা। তখন অপারেটররা প্রতি কিলোবাইট দুই পয়সা হারে বিক্রি করত। আর এখন প্রতি মেগাবাইট ব্যান্ডউইথের মূল্য ছিল ৮ হাজার টাকায় নেমে এসেছে। এখনও গ্রাহককে একই দামে ব্যান্ডউইথ কিনতে হচ্ছে।
পি ওয়ান লিখে ব্যবহার করা এই পদ্ধতির কারণে মাসে গ্রাহকরা কোটি কোটি টাকার ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে বলেও জানিয়েছে বিটিআরসি। তারা বলছে, এই পি ওয়ান প্যাকেজের মাধ্যমে এক মাসে ২৫ হাজার টাকা বিল ওঠার খবরও তারা পেয়েছেন। গ্রাহককে এভাবে প্রতারিত হতে দেয়া যায় না। এক্ষেত্রে বিটিআরসি কয়েকটি বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছে। পি ওয়ান প্যাকেজের মাধ্যমে মাসে গ্রাহক সর্বোচ্চ ১০০ টাকা ব্যবহার করতে পারবে। ১০০ টাকা পেরিয়ে গেলেই তার প্যাকেজটি অন্য প্রচলিত প্যাকেজে চলে যাবে। তবে পরবর্তী মাসের প্রথম দিন থেকে এটি আগের প্যাকেজে চলে আসবে গ্রাহক।

0 Comments:

Post a Comment

<< Home