kawsar

Sunday, October 07, 2012

বিটিআরসি চেয়ারম্যান থাকাকালীন জিয়া আহমেদের কার্যক্রম

মোহাম্মদ কাওছার উদ্দীন
বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশনের (বিটিআরসি) চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) জিয়া আহমেদ (৫৮) গত ১০ সেপ্টেম্বর সোমবার ভোর ৩টা ৩০ মিনিটে ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ইন্তেকাল করেছেন।
২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি তিন বছরের জন্য বিটিআরসির চেয়ারম্যান পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পান জিয়া আহমেদ। গত ২১ ফেব্রুয়ারি সেই মেয়াদ শেষ হওয়ার পর আরও এক বছরের জন্য তাকে নিয়োগ দেয়া হয়। বিগত চারদলীয় জোট সরকারের সময় সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পদে থাকা জিয়া আহমেদকে অবসরে পাঠানো হলেও ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে তাকে বাহিনীতে ফিরিয়ে মেজর জেনারেল হিসেবে পদোন্নতি দেয়।
তিনি ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কমিশন প্রাপ্ত হন। তিনি সিগন্যাল কোরে একজন চৌকস ও দক্ষ অফিসার হিসেবে সুনাম অর্জন করেছিলেন। তিনি সেনাবাহিনীতে সিগন্যাল ট্রেনিং সেন্টার অ্যান্ড স্কুলে কমান্ডেন্টসহ সিগন্যাল স্কুলে প্রধান প্রশিক্ষক ও অন্য পদে দায়িত্ব পালন করেন। পাশাপাশি তিনি সামরিক ও বেসামরিক বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থায় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। তিনি মোজাম্বিকে জাতিসংঘের শান্তি মিশনে চিফ মিলিটারি পার্সোনাল অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
বিটিআরসি চেয়ারম্যান হিসেবে সাড়ে তিন বছরেরও বেশি সময় দায়িত্ব পালন করা জিয়া আহমেদের কিছু কার্যক্রম এখানে তুলে ধরা হলো :
১. আইটিইউর কাউন্সিলর : প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ ইউনিয়নের (আইটিইউ) কাউন্সিলর পদে নির্বাচন করে বিজয় পায় বাংলাদেশ। ২০১০ সালের অক্টোবরে মেক্সিকোতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ১৫৮ দেশের মধ্যে ১২৩ দেশের সমর্থন পেয়ে ৬ষ্ঠ স্থান পায় বাংলাদেশ। নির্বাচনে প্রতিবেশী পাকিস্তান এবং শ্রীলঙ্কা পরাজিত হয়েছে বড় ব্যবধানে। এ নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিল বিটিআরসি।
২. টুজি লাইসেন্স নবায়ন : গ্রামীণফোন, বাংলালিংক, রবি এবং সিটিসেলের দ্বিতীয় প্রজন্মের (টুজি) লাইসেন্স নবায়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন জিয়া আহমেদ। লাইসেন্স নবায়নের নীতিমালা তৈরি করা থেকে শুরু হয় এর কাজ। পরে আগামী ১৫ বছরের জন্যে এ চার অপারেটরকে দেয়া হয়েছে লাইসেন্স। গত ৭ আগস্ট চার অপারেটরের কাছে হস্তান্তর করা হয় এ লাইসেন্স।
৩. সবচে বেশি রাজস্ব আয় : তার আমলেই বিটিআরসি সবেচেয়ে বেশি পরিমাণ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা হয়। তিনি ঐকান্তিকভাবে চেষ্টা করেছিলেন, সরকারের রেভিনিউ যেন কোন অবস্থাতেই কমে না যায়। তিনি তরঙ্গ মূল্যের পরিমাণ যা ঠিক করেছিলেন, সেটা হয়নি বলে তিনি মন খারাপ করতেন। বলতেন, দেশের কোষাগারে আরও বেশি টাকা জমা হতো। কিন্তু বিভিন্ন লবি গ্রুপের কারণে সেই পরিমাণ ফি তিনি রাখতে পারেননি।
৪. স্পেকট্রাম পুনর্বিন্যাস : দেশের টেলিযোগাযোগ খাতের অন্যতম সেরা সিদ্ধান্ত ছিল এটি। গত ৩ মে রাত ১২টার পর মোবাইল ফোন অপারেটরদের ১৮০০ ব্যান্ডের স্পেকট্রাম পুনর্বিন্যাস করে বিটিআরসি। এ পুনর্বিন্যাসের ফলে বিটিআরসি ১৫ দশমিক ৬ মেগাহার্টজ তরঙ্গ বের করে আনতে পেরেছে। যার বাজার মূল্য প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা। বিটিআরসি এ স্পেকট্রাম প্রয়োজনে অন্য কোন অপারেটরের কাছে বিক্রি করতে পারবে।
আগে ১৮০০ ব্যান্ডে গ্রামীণফোনের ১৪ দশমিক ৬ মেগাহার্টজ স্পেকট্রাম ছিল তিন জায়গায়। এখন এ পরিমাণ স্পেকট্রাম এক জায়গায় নিয়ে আসা হয়েছে। একইভাবে রবিও তিনটি ভিন্ন স্থানে গ্রামীণফোনের সমপরিমাণ তরঙ্গ ব্যবহার করেছে। অন্যদিকে আবার বাংলালিংক চারটি জায়গা থেকে কিছু কিছু মিলিয়ে ১২ দশমিক ৬ মেগাহার্টজ তরঙ্গ ব্যবহার করত। এখন এগুলো সব একত্রিত করা হচ্ছে। ফলে গার্ড ব্যান্ড কমে গেছে। তাতে করে বাড়তি তরঙ্গ পাওয়া গেছে।
৫. অপারেটরদের অডিট : যদিও গ্রামীণফোনের অডিট কার্যক্রম নিয়ে বেশ বিতর্ক আছে, কিন্তু তারপরও এটি ঠিক যে আইনের থাকলেও গত দশ বছরে বিটিআরসি একবারের জন্যেও এ বিষয়ে কোন উদ্যোগ নেয়নি। জিয়া আহমেদ এ বিষয়ে কার্যক্রম হাতে নেন। এখানে সরকারের রিভিনিউ শেয়ারিং রয়েছে। তাই প্রতি অর্থবছরেই সেটা অডিট করাটা জরুরি। কিন্তু সেই কাজটি জিয়া আহমেদ এসে শুরু করেছিলেন এবং তিনি জোর দিয়ে বলতেন, গ্রামীণফোনের অডিট নিয়ে যে মামলা আছে, তাতে তিনি জিতবেন। এখন বাংলালিংক, রবি এবং সিটিসেলে অডিটের প্রক্রিয়া শুরু হতে যাচ্ছে।
৬. দশ সেকেন্ডের পালস : যদিও টেলিটক ছাড়া আর কেউ এখনও এটি কার্যকর করেনি। কিন্তু তারপরও এক্ষেত্রে তিনি অনেক দূর এগিয়েছিলেন। আগামী ১৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে সব মোবাইল ফোন অপারেটরের এটি কার্যকর করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
তিনি জানিয়ে ছিলেন, দশ সেকেন্ডের পালস কার্যকর করা গেলে এরপর প্রতি সেকেন্ডের পালসও তিনি কার্যকর করার ব্যবস্থা করবেন।
৭. থ্রিজি লাইসেন্স : তৃতীয় প্রজন্মের (থ্রিজি) একটি খসড়া নীতিমালা তৈরি করে গত ২৭ মার্চ তা টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। মন্ত্রণালয় এখনও সে বিষয়ে কোন মতামত জানায়নি। জিয়া আহমেদের করা নীতিমালায় বিদ্যমান অপারেটরগুলোর বাইরে আরও একটি নতুন অপারেটরকে সুযোগ দেয়ার কথা বলা হয়েছে।
৮. ফেসবুকে প্রচারণা : জিয়া আহমেদের সর্বশেষ কার্যক্রমগুলোর একটি ফেসবুক প্রচারণা। গত সপ্তাহে বিটিআরসি দেশের প্রথম কোন সংস্থা হিসেবে ফেসবুকে অন্তর্ভুক্ত হয়। বিটিআরসির জন্য নতুন ফেসবুক পেজ খোলা হয়। ফেসবুকে তারা তাদের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত জানানোর পর সেখান থেকে জনগণের ফিডব্যাকও নিতে শুরু করে।
৯. সামাজিক দায়বদ্ধতা তহবিল : অন্য দেশে থাকলেও বাংলাদেশে এ বিষয়ে আগে কেউ কখনও কিছু জানত না। জিয়া আহমেদ চারটি অপারেটরের লাইসেন্স নবায়নের সময় প্রথম এ বিষয়টি যুক্ত করেন। যেখানে বলা হয় অপারেটররা তাদের আয়ের এক শতাংশ এ তহবিলে দেবে। পরে তথ্যপ্রযুক্তিসহ সংশ্লিষ্ট খাতের উন্নয়নের জন্যেই তা খরচ করবে সরকার। ইতোমধ্যে এ খাতের টাকা জমা পড়তে শুরু করেছে। তবে টাকা খরচের বিষয়ে তাদের তৈরি করা নীতিমালা এখনও অনুমোদন করেনি টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়।
১০. ভাস অপারেটর সৃষ্টির উদ্যোগ : দেশীয় অপারেটরদের মোবাইলের ভ্যালু অ্যাডেড সেবায় নিয়ে আসার জন্যে এ বছরই প্রথম বিটিআরসি উদ্যোগ নেয়। তিনি মনে করতেন, ভ্যালু অ্যাডেড সার্ভিসের মাধ্যমে দেশে নতুন ধরনের উদ্যোক্তা তৈরি হবে এবং মোবাইল ফোন অপারেটররা পৃথিবীর অন্য দেশের মতো ভাস সেবা উন্মুক্ত রাখবে, যেন যে কেউ এ কানেক্টিভিটি ব্যবহার করে নতুন নতুন সেবা নিয়ে আসতে পারে। সে বিষয়ে একটি নীতিমালাও তৈরি করে তারা। কিন্তু মন্ত্রণালয় সেটিও এখনও অনুমোদন করেনি।
১১. বাংলাদেশের নিজস্ব স্যাটেলাইট স্থাপনের উদ্যোগ : দেশের প্রথম স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু-১ উৎক্ষেপণে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম শুরু করেছিল বিটিআরসি। এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা সমন্বিত চিঠি গত ৬ সেপ্টেম্বর ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের জন্য এরই মধ্যে ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়নের (আইটিইউ) কাছে কক্ষেপথের ১০২ ডিগ্রি পূর্বে সস্নট চেয়েছে বিটিআরসি। চলতি বছরের ২৯ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রের স্পেস পার্টনারশিপ ইন্টারন্যাশনালের (এসপিআই) সঙ্গে চুক্তিও করেছে বিটিআরসি।

0 Comments:

Post a Comment

<< Home