মোহাম্মদ কাওছার উদ্দীন
আন্তর্জাতিক কল রেকর্ড রাখতে কারিগরি সীমাবদ্ধতা
এবং লাইসেন্সপ্রাপ্তির পর দীর্ঘ দিনেও বিটিসিএল আইসিএক্স মেশিন না বসানোয়
দিন দিন বাড়ছে ভিওআইপির অবৈধ ব্যবহার। এরই মধ্যে মাত্র ৭ মাসে শুধু একটি
আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের মাধ্যমে সরকারের বেহাত হয়েছে ৩ কোটি ২৭ লাখ টাকা।
আর এই কাজে মদদ দিচ্ছে সরকারেরই একটি অংশ। অভিযোগ রয়েছে, সরকারের প্রায়
অধিকাংশ মন্ত্রী এবং ডাকসাইটে এমপিদের কাছেই রয়েছে অবৈধ ভিওআইপি কলের
এসটিএম লাইন। আর এই লাইনগুলোর বৈধ ব্যবহার নিয়ে কোন নজদারি নেই।
সূত্র মতে, ২০০৮ সাল থেকে সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন
কোম্পানি (বিটিসিএল) ও বাংলাদেশ সাবমেরিন ক্যাবল কোম্পানি লিমিটেড
(বিএসসিসিএল) মাধ্যমে শুরু হয় আন্তর্জাতিক কলের গেটওয়ের অবৈধভাবে ব্যবহার।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, হংকংয়ের ক্যারিয়ারের স্থানীয় আইসিএম গ্রুপের মাধ্যমে
দিনের পর দিন হাতছাড়া হচ্ছে সরকারের প্রাপ্ত অর্থ। এছাড়াও ২৮টি
ক্যারিয়ারের সঙ্গে বিটিসিএল ও বিএসসিসিএল চুক্তি এবং সংশ্লিষ্ট হিসাবের
অনিয়ম খতিয়ে দেখছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ইতোমধ্যে অনিয়মের বিষয়টি
খতিয়ে দেখে মামলা করার প্রস্তুতি নিয়েছে দুদক।
সরকারকে ফাঁকি দিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ল্যান্ডফোন কোম্পানি বিটিসিএলের একাধিক
কর্মকর্তা এই টাকা নিজেদের পকেটে পুরেছেন। ভুয়া ব্যাংক গ্যারান্টিসহ
অন্যান্য জাল কাগজপত্রের মাধ্যমে চুক্তি করে লাভের অংশ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে
রাষ্ট্র। কম্পিউটার থেকে কলরেকর্ড পর্যন্ত মুছে ফেলেন তারা।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, ই-ওয়ান থেকে এসটিএম লাইনে অবৈধভাবে আন্তর্জাতিক কল
বেড়েছে। সবগুলো ক্যারিয়ারের এক বছরের লুটপাটের হিসাব নিতে পারলে টাকার অঙ্ক
কয়েকশ কোটি ছাড়িয়ে যাবে। এদিকে অনিয়মের বিষয়টি ঢাকা দেয়ার জন্য বিটিসিএলের
কর্মকর্তার নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে তথ্য দেয়ার বিষয়ে। এ বিষয়ে
অনেক তথ্যই দিতে চায়নি বিটিসিএল।
উল্লেখ্য, এক দেশ থেকে অন্য দেশে টেলিফোন কল নেয়ার ক্ষেত্রে মাঝখানে কিছু
কোম্পানি ক্যারিয়ার হিসেবে কাজ করে। বিভিন্ন কোম্পানির নাম ব্যবহার করে
বিদেশি এসব ক্যারিয়ারের মাধ্যমেই প্রতিদিন দেশে কোটি কোটি মিনিটের টেলিফোন
কল আসে। প্রতি মিনিটের বৈধ কলের জন্য তিন সেন্ট করে দেশে আসার কথা। তবে
ভুয়া চুক্তির মাধ্যমে তথ্য মুছে ফেলে টাকার পুরোটাই লুটে নেয়া হচ্ছে অনেক
দিন থেকে।
জানা গেছে, হংকং ক্যারিয়ারের মাধ্যমে আইসিএম গ্রুপের নাম ব্যবহার করে তিন
কোটি ২৭ লাখ ১৯ হাজার ১৯০ কোটি লোপাট হয়েছে। ২০১০ সালের সেপ্টেম্বর থেকে
২০১১ সালের মার্চ পর্যন্ত ৭ মাসে তাদের মাধ্যমে কল লেনদেনে বিটিসিএলের এই
ক্ষতি হয়।
সংশ্লিষ্ট নথি থেকে প্রকাশ, ২০০৮ সালে আইসিএম গ্রুপের নাম ব্যবহার করে
স্থানীয় সাবিল আইটি লিমিটেড আবেদন করে। তারা নিজেদেরকে আইসিএম গ্রুপ
স্থানীয় প্রতিনিধি দাবি করে। কিন্তু এ সংক্রান্ত কোন কাগজপত্র তদন্তকালে
পায়নি দুদক কর্মকর্তা। এমনকি সাবিল আইটি লিমিটেডের মহাখালি ডিওএইচএস-এর যে
ঠিকানা ব্যবহার করেছে সেখানেও এ কোম্পানির ঠিকানা মেলেনি। অপরদিকে চুক্তির
আগে ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেড থেকে দুটি ভুয়া ব্যাংক গ্যারান্টি দাখিল করে
এই কোম্পনিটি। কিন্তু এর কিছুই ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সামনে উপস্থাপন করা
হয়নি। বরং যোগসাজশে তাদের সঙ্গে চুক্তি করে সংশ্লিষ্ট বিভাগ।
নির্দিষ্ট এই ক্যারিয়ারের মাধ্যমে লোপাট হওয়া টাকার দায় বিটিসিএলের তৎকালীন
পরিচালক (আন্তর্জাতিক) মাহফুজার রহমানের ওপরেই বর্তায়। ভুয়া ব্যাংক
গ্যারান্টি এবং ভুয়া কাগজপত্রের মাধ্যমে চুক্তি করার পর ২০০৯ সালের ১৫
ডিসেম্বর একবার তা বাতিল হয়। পরে আবারও একক প্রচেষ্টায় মাহফুজার রহমান
কোম্পানিটির সঙ্গে চুক্তি করেন।
দুদকের এক কর্মকর্তা পরিচয় গোপন রেখে বলছেন, 'নিজে লাভবান হয়ে কিংবা অন্যকে
লাভবান করানোর অসৎ উদ্দেশ্যে ভুয়া কাগজপত্রের মাধ্যমে কাজ করে সরকারকে
আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত' করে ওই কর্মকর্তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন বলে
প্রতীয়মান হয়।' মাহফুজার রহমান বর্তমানে রাষ্ট্রায়ত্ত মোবাইল ফোন অপারেটর
টেলিটকের জেনারেল ম্যানেজার (প্রশাসন) হিসেবে কাজ করছেন।
এদিকে দুদক বলছে, সবগুলো ক্যারিয়ার নিয়ে তাদের তদন্ত কাজ শেষ হলে এ বিষয়ে
মামলার উদ্যোগ দেবেন। এর আগে চলতি বছরের ৩ জুলাই এ সংক্রান্ত তদন্তের জন্য
চিঠি দিয়ে দুদক থেকে বিটিসিএলের কাছে সহযোগিতা চাওয়া হয়। দুদক থেকে বলা হয়,
চুক্তিপত্র, ব্যাংক গ্যারান্টি, কার্যাদেশ প্রদানসহ কয়েকটি বিষয় তদন্ত
করতে চায় তারা।
আইসিএম গ্রুপ ইনকরপোরেশন ছাড়াও দুদক আরও যে ক্যারিয়ার বিষয়ে তদন্ত করছে
সেগুলো হলো_ যুক্তরাষ্ট্রের পাঁচটি ক্যারিয়ার অ্যারিস্টোক্রাট সার্ভিস, আই
এজ ফোন, ফুসিয়ন, স্ট্রাক হাই, এনটেল। সিঙ্গাপুরের ৬টি ক্যারিয়ার ডিজিটেক,
হ্যাক জাপান, আইপাওয়ার, এনটিএস গ্লোবাল, ওয়ান ওয়ার্ল্ড, সাইন ওয়ার্ল্ড।
ইংল্যান্ডের ৯টি ক্যারিয়ার অ্যাকসিফ টেল, রাইয়ান টেল, সিক্সল টেল, বিডিএইউ,
জিডিএক্সসি, লাইকা টেল, মনি এন্টারপ্রাইস, টেলিলিংক, ওয়েসিদ্বন নেটওয়ার্ক।
কানাডার পাঁচটি ক্যারিয়ার মাই আরবা, ইবসিস, ইকোক্যারিয়ার, প্রাইম টেল ও
শ্যাম টেল। এছাড়াও মালয়েশিয়ার দেশি ডিজিটাল এবং অস্ট্রেলিয়ার ওয়ার্ল্ডটেল
প্রাইভেট লিমিটেড এর নামে অনিয়ম রয়েছে।
দুদক বলছে, সবগুলো ক্যারিয়ারের সঙ্গে বিটিসিএলের সম্পর্কের বিষয়সহ অন্যান্য
সব কিছু তারা তদন্তের আওতায় আনছেন। এর মধ্যে সরকারের কি পরিমাণ টাকার
ক্ষতি হয়েছে এবং এর সঙ্গে কোন কোন কর্মকর্তা জড়িত রয়েছে তা বেরিয়ে আসবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বিটিসিএল এমন সব ভুয়া ক্যারিয়ারের মাধ্যমে কল
আনলেও যেহেতু তাদের সিডিআরে (কল ডিটেইল রেকর্ডস) কোন তথ্যই থাকে না সে
কারণে শেষ পর্যন্ত লুটপাট ধরা যায় না। তবে এই লোপাটের সঙ্গে সরকারের
একেবারে ওপর মহলও জড়িত রয়েছে বলে জানিয়েছে একাধিক সূত্র।